বৃহস্পতিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১১

বাংলাদেশের একমাত্র জলপ্রপাত মাধবকুন্ড

বাংলাদেশের বুকের মধ্যে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, কুশিয়ারা, মনু আর ফালাই নদী চিরচঞ্চলার মত ছুটে চলছেশস্য শ্যামল বাংলার স্নিগ্ধ তরুছাঁয়া পুষ্প পল্লবের শোভা আর বিহঙ্গের কলগীতি, মধুর কুঞ্জল প্রভাতের অরুনরাগ ও সায়াহ্নের স্তব্ধ গাম্ভীর্য এক প্রকৃতির লীলা নিকেতন পরিণত করেছেমৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানায় অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র জলপ্রপাত সৃষ্ট কুন্ড, যার নাম মাধবকুন্ড প্রায় তিরাশী মিটার উঁচু পাহাড়ের উপর থেকে জলরাশী এর গাঁ বেয়ে অবিরাম ধারায় সাঁ সাঁ শব্দে নীচে পড়ছেঅবিরাম পতনের ফলে নীচে সৃষ্টি হয়েছে কুন্ডের আর কুন্ডের প্রবাহমান স্রোতধারা বরিষ ধারার মাঝে শান্তির বারিধারার মতো মাধব ছড়া দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছেউল্লেখ যোগ্য যে বিশ্বের সবচেয়ে জলপ্রপাত হচ্ছে এঞ্জেলস ফলস ইহা ভেনুজুয়োলায় অবস্থিতএর উচ্চতা ৩২১২ ফুট
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা মাধবকুন্ডের ঝর্ণা


মাধবকুন্ডের নামকরণ সম্পর্কে কথিত আছে যে শীহট্টের রাজা গঙ্গাধ্বজ ওরফে গোবর্ধন পাথারিয়া পাহাড়ে একটি বিশ্রামাগার নির্মাণ শুরু করলে তথায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় মাটির নীচে একজন সন্ন্যাসীকে দেখতে পানতখন তিনি উক্ত সন্ন্যাসীর পদ বন্দনা ও স্তুতি শুরু করলে সন্ন্যাসী তাকে নানা উপদেশ সহ তাকে (সন্ন্যাসীকে) এ কুন্ডে মাধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথীতে বিসর্জন দিতে নির্দেশ দেনরাজা তা পালন করেনসন্ন্যাসী বিসর্জিত হওয়া মাত্র তিন বার মাধব, মাধব, মাধব নামে দৈববাণী হয়সম্ভবতঃ এ থেকে মাধবকুন্ড নামের উপত্তিআবার কারো কারো মতে মহাদেব বা শিব এর পূর্ব নাম মাধব এবং এর নামানুসারেই তার আবির্ভাব স্থানের নাম মাধবকুন্ড এখানে উল্লেখ্য যে মাধব তীর্থের জলপ্রপাত যে কুন্ডের সৃষ্টি করেছে সে কুন্ডের পার্শ্বেই স্থাপন করা হয়েছে শিব মন্দিরযে টিলার গাঁ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে এ টিলা সম্পূর্ণ পাথরেরএছাড়া নীচে ছড়ার মধ্যে ছড়িয়ে আছে বিরাটকায় সুদৃশ্য পাথর রাশি যা দর্শনার্থীদের অত্যন্ত উপভোগ্যকুন্ডের ডান পার্শ্বে পাথরের গায়ে াকেটি পাথরের গহব্বর বা গুহার সৃষ্টি হয়েছেস্থানীয় ভাষায় এ গুহাকে কাব বলা হয়এ কাব প্রাকৃতিক ভাবেই সৃষ্টিসর্বশেষ ১৩৪২ সালে বিষ্ণুদাস সন্ন্যাসী মাধবকুন্ড পশ্চিমাংশে কমলা বাগান করার উদ্দেশ্যে যামিনী ও কথা সিন্দু দাস সহ নবীন বাবুকে অনুসঙ্গী করে কমলা বাগান স্থাপন করেন১৩৪৬ সালে কমলা বাগান সহ মাধবকুন্ড তত্ত্বাবধানে দায়িত্ব তাদের উপর ন্যাস্ত করেনসেই কমলা বাগান আজও আছে এবং এর সুনাম বাংলাদেশের সর্বত্রতখনকার সময় মাধবকুন্ড অঞ্চল ছিল হিংস্র পশুর চারণ ক্ষেত্রপুরী বাবা এবং নাগ বাবার সাথে বনের রাজা বাঘেরও সখ্যতা ছিল বলে জানা যায়মাধবকুন্ডে দুটি বিশেষত্ব আছে (১) অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য মন্ডিত স্থান এবং (২) হিন্দুদের তীর্থস্থান যা মাধব তীর্থ নামে সকলের কাছে পরিচিত

মাধবকুন্ডের অপুর্ব সৌন্দর্য্যের কাব্যিক ছন্দের কিছু অংশ তুলে ধরা হলঃ-
টিলা সমতল উপত্যকা সমেত             শ্রী ভূষিতা শ্রী ভুমি
কতোনাভরন ধর তুমি                 তোমাতেই রয় শোভা বিষ্ময়
কুঞ্জ কানন শ্রী কানন শ্রী মনোরম         মাধবকুন্ড জলপ্রপাত


পাথারিয়া পাহাড়ের প্রাচীন নাম ছিল আদম আইর পাহাড়পাথারিয়া পাহাড়ের বুকে সৃষ্ট এই জলপ্রপাত এর অবস্থান সীমান্তবর্তী থানা বড়লেখা ৮নং দক্ষিনভাগ ইউনিয়নের অধীনে গৌর নগর মৌজার অর্ন্তগতপাথারিয়া পাহাড়টি কঠিন পাথরের গঠিত পাহাড়ের বৃহ অংশ জুড়ে ছড়া রয়েছেছড়ার উপরের অংশের নাম গঙ্গমার ছড়া আর নীচের অংশের নাম আধব ছড়াপ্রায় ২০০ ফুট উঁচু থেকে নীচে খাড়াভাবে পানি গড়িয়ে পড়ছেপানি পড়ে সৃষ্টি হয়েছে বিরাট কুন্ডেরমাধবকুন্ড আসতে মৌলভীবাজার জেলা শহর থেকে জুরী, কাঠালতলী হয়ে ৭০ কিলোমিটার এবং সিলেট থেকে বিয়ানীবাজার হয়ে ৭২ কিলোমিটার আর কুলাউড়া রেলওয়ে জংশন থেকে মাত্র ৩২ কিলোমিটার দুরুত্বপাহাড়ের উপর থেকে প্রস্তরের উপর দিয়ে ছুটে আসা পানির স্রোত দুভাগে বিভক্ত হয়ে হঠা খাড়াভাবে উঁচু পাহাড় থেকে একবার নীচে পড়ে যায়পাহাড়ের গাঁ বেয়ে পড়ে নাএত দুটি ধারা সৃষ্টি হয়একটি বড়, একটি ছোটবর্ষাকালে ধারা দুটি মিশে যায়জলরাশি যেখানে পড়ছে, তার চর্তুরদিকে পাহাড়তার নীচে কুন্ডআর তার বিপরীতে একটি গুহার মত বিশাল গর্ত আছেএই স্থান অনেক গভীরআর এই কুন্ডই মাধবকুন্ডকুন্ডের মধ্যে জেগে উঠা একটি পাথর আছেএই পাথরের বুক জলে দাড়াঁনো যায়যে পাহাড়ের গাঁ বেয়ে পানি পড়ছে সে পাহাড় সম্পূর্ণ পাথরের তৈরি প্রাকৃতিক ভাবেমাধবকুন্ডে অত্যন্ত আকর্ষণ হলো পাথর১৯৯৯ সালের গৃহীত পরিমাপ অনুসারে পতনশীল পানি ধারের পাশ দিয়ে উপর থেকে কুন্ডের গভীরতা সহ মাধবকুন্ডের উচ্চতা ১৬২ ফুটমাধবকুন্ডে বাংলাদেশের পর্যটন কর্পোরেশন একটি রেষ্টুরেন্ট নির্মাণ করেছে
(তথ্যঃ সিলেট বিভাগের ইতিবৃত্ত- "হিস্টোরিয়ান ডঃ মুমিনুল হক" পৃষ্টা ১১৪-১১৫)
(ফটো সংগ্রহেঃ মিশকাত আহমেদ)

1 টি মন্তব্য: