বাংলাদেশের বুকের মধ্যে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, কুশিয়ারা, মনু আর ফালাই নদী চিরচঞ্চলার মত ছুটে চলছে। শস্য শ্যামল বাংলার স্নিগ্ধ তরুছাঁয়া পুষ্প পল্লবের শোভা আর বিহঙ্গের কলগীতি, মধুর কুঞ্জল প্রভাতের অরুনরাগ ও সায়াহ্নের স্তব্ধ গাম্ভীর্য এক প্রকৃতির লীলা নিকেতন পরিণত করেছে। মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানায় অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র জলপ্রপাত সৃষ্ট কুন্ড, যার নাম ’মাধবকুন্ড’ । প্রায় তিরাশী মিটার উঁচু পাহাড়ের উপর থেকে জলরাশী এর গাঁ বেয়ে অবিরাম ধারায় সাঁ সাঁ শব্দে নীচে পড়ছে। অবিরাম পতনের ফলে নীচে সৃষ্টি হয়েছে কুন্ডের আর কুন্ডের প্রবাহমান স্রোতধারা বরিষ ধারার মাঝে শান্তির বারিধারার মতো মাধব ছড়া দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উল্লেখ যোগ্য যে বিশ্বের সবচেয়ে জলপ্রপাত হচ্ছে ’এঞ্জেলস ফলস’ । ইহা ভেনুজুয়োলায় অবস্থিত। এর উচ্চতা ৩২১২ ফুট।
![]() |
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা মাধবকুন্ডের ঝর্ণা |
মাধবকুন্ডের নামকরণ সম্পর্কে কথিত আছে যে শীহট্টের রাজা গঙ্গাধ্বজ ওরফে গোবর্ধন পাথারিয়া পাহাড়ে একটি বিশ্রামাগার নির্মাণ শুরু করলে তথায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় মাটির নীচে একজন সন্ন্যাসীকে দেখতে পান। তখন তিনি উক্ত সন্ন্যাসীর পদ বন্দনা ও স্তুতি শুরু করলে সন্ন্যাসী তাকে নানা উপদেশ সহ তাকে (সন্ন্যাসীকে) এ কুন্ডে মাধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথীতে বিসর্জন দিতে নির্দেশ দেন। রাজা তা পালন করেন। সন্ন্যাসী বিসর্জিত হওয়া মাত্র তিন বার মাধব, মাধব, মাধব নামে দৈববাণী হয়। সম্ভবতঃ এ থেকে ’মাধবকুন্ড’ নামের উৎপত্তি। আবার কারো কারো মতে মহাদেব বা শিব এর পূর্ব নাম মাধব এবং এর নামানুসারেই তার আবির্ভাব স্থানের নাম ’মাধবকুন্ড’ । এখানে উল্লেখ্য যে মাধব তীর্থের জলপ্রপাত যে কুন্ডের সৃষ্টি করেছে সে কুন্ডের পার্শ্বেই স্থাপন করা হয়েছে শিব মন্দির। যে টিলার গাঁ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে এ টিলা সম্পূর্ণ পাথরের। এছাড়া নীচে ছড়ার মধ্যে ছড়িয়ে আছে বিরাটকায় সুদৃশ্য পাথর রাশি যা দর্শনার্থীদের অত্যন্ত উপভোগ্য। কুন্ডের ডান পার্শ্বে পাথরের গায়ে াকেটি পাথরের গহব্বর বা গুহার সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় ভাষায় এ গুহাকে ’কাব’ বলা হয়। এ কাব প্রাকৃতিক ভাবেই সৃষ্টি। সর্বশেষ ১৩৪২ সালে বিষ্ণুদাস সন্ন্যাসী মাধবকুন্ড পশ্চিমাংশে কমলা বাগান করার উদ্দেশ্যে যামিনী ও কথা সিন্দু দাস সহ নবীন বাবুকে অনুসঙ্গী করে কমলা বাগান স্থাপন করেন। ১৩৪৬ সালে কমলা বাগান সহ মাধবকুন্ড তত্ত্বাবধানে দায়িত্ব তাদের উপর ন্যাস্ত করেন। সেই কমলা বাগান আজও আছে এবং এর সুনাম বাংলাদেশের সর্বত্র। তখনকার সময় মাধবকুন্ড অঞ্চল ছিল হিংস্র পশুর চারণ ক্ষেত্র। পুরী বাবা এবং নাগ বাবার সাথে বনের রাজা বাঘেরও সখ্যতা ছিল বলে জানা যায়। মাধবকুন্ডে দু’টি বিশেষত্ব আছে (১) অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য মন্ডিত স্থান এবং (২) হিন্দুদের তীর্থস্থান যা মাধব তীর্থ নামে সকলের কাছে পরিচিত।
মাধবকুন্ডের অপুর্ব সৌন্দর্য্যের কাব্যিক ছন্দের কিছু অংশ তুলে ধরা হলঃ-
টিলা সমতল উপত্যকা সমেত শ্রী ভূষিতা শ্রী ভুমি
কতোনাভরন ধর তুমি তোমাতেই রয় শোভা বিষ্ময়
কুঞ্জ কানন শ্রী কানন শ্রী মনোরম মাধবকুন্ড’ জলপ্রপাত
পাথারিয়া পাহাড়ের প্রাচীন নাম ছিল আদম আইর পাহাড়। পাথারিয়া পাহাড়ের বুকে সৃষ্ট এই জলপ্রপাত এর অবস্থান সীমান্তবর্তী থানা বড়লেখা ৮নং দক্ষিনভাগ ইউনিয়নের অধীনে গৌর নগর মৌজার অর্ন্তগত। পাথারিয়া পাহাড়টি কঠিন পাথরের গঠিত পাহাড়ের বৃহৎ অংশ জুড়ে ছড়া রয়েছে। ছড়ার উপরের অংশের নাম গঙ্গমার ছড়া আর নীচের অংশের নাম আধব ছড়া। প্রায় ২০০ ফুট উঁচু থেকে নীচে খাড়াভাবে পানি গড়িয়ে পড়ছে। পানি পড়ে সৃষ্টি হয়েছে বিরাট কুন্ডের। মাধবকুন্ড আসতে মৌলভীবাজার জেলা শহর থেকে জুরী, কাঠালতলী হয়ে ৭০ কিলোমিটার এবং সিলেট থেকে বিয়ানীবাজার হয়ে ৭২ কিলোমিটার আর কুলাউড়া রেলওয়ে জংশন থেকে মাত্র ৩২ কিলোমিটার দুরুত্ব। পাহাড়ের উপর থেকে প্রস্তরের উপর দিয়ে ছুটে আসা পানির স্রোত দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে হঠাৎ খাড়াভাবে উঁচু পাহাড় থেকে একবার নীচে পড়ে যায়। পাহাড়ের গাঁ বেয়ে পড়ে না। এত দুটি ধারা সৃষ্টি হয়। একটি বড়, একটি ছোট। বর্ষাকালে ধারা দু’টি মিশে যায়। জলরাশি যেখানে পড়ছে, তার চর্তুরদিকে পাহাড়। তার নীচে কুন্ড। আর তার বিপরীতে একটি গুহার মত বিশাল গর্ত আছে। এই স্থান অনেক গভীর। আর এই কুন্ডই মাধবকুন্ড। কুন্ডের মধ্যে জেগে উঠা একটি পাথর আছে। এই পাথরের বুক জলে দাড়াঁনো যায়। যে পাহাড়ের গাঁ বেয়ে পানি পড়ছে সে পাহাড় সম্পূর্ণ পাথরের তৈরি প্রাকৃতিক ভাবে। মাধবকুন্ডে অত্যন্ত আকর্ষণ হলো পাথর। ১৯৯৯ সালের গৃহীত পরিমাপ অনুসারে পতনশীল পানি ধারের পাশ দিয়ে উপর থেকে কুন্ডের গভীরতা সহ মাধবকুন্ডের উচ্চতা ১৬২ ফুট। মাধবকুন্ডে বাংলাদেশের পর্যটন কর্পোরেশন একটি রেষ্টুরেন্ট নির্মাণ করেছে।
(তথ্যঃ সিলেট বিভাগের ইতিবৃত্ত- "হিস্টোরিয়ান ডঃ মুমিনুল হক" পৃষ্টা ১১৪-১১৫)
(ফটো সংগ্রহেঃ মিশকাত আহমেদ)
1 মন্তব্য(গুলি):
খুব ভাল তথ্য।